একটি ইলিশ তিন থেকে ২১ লক্ষ পর্যন্ত ডিম দেয়। মিঠাপানিতে ডিম দেওয়ার পর ২২-২৬ ঘণ্টার মধ্যে ডিম ফুটে বাচ্চা হয় এবং ৫-১৫ সেন্টিমিটার আকার পর্যন্ত ৫-৭ মাস এরা নদীতে থাকে। পরবর্তীতে আবার সাগরের দিকে ধাবিত হয়। ইলিশ ১-২ বছর বয়সে (২২-২৫ সেন্টিমিটার আকারে পুরুষ ; ২৮-৩০ সেন্টিমিটার আকারের স্ত্রী) প্রজননক্ষম হয়। তখন এরা আবার মিঠাপানিতে বসবাস শুরু করে। তখনই সাগর মোহনায় স্ত্রী ইলিশ মাছ অপেক্ষাকৃত বেশি ধরা পড়ে। ইলিশ মাছ সারা বছরই কমবেশি ডিম দেয়; তবে সেপ্টেম্বর-অক্টোবরই হচ্ছে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম। অক্টোবর অর্থাত্ আশ্বিন মাসের প্রথম পূর্ণিমার ভরা চাঁদে ওরা প্রধানত ডিম ছাড়ে। এজন্য আশ্বিনের বড় পূর্ণিমার পূর্বের চার দিন এবং পরের ১৭ দিন (৪+১+১৭) ইলিশ আহরণ, বিতরণ, বিপণন, পরিবহন, মজুদ ও বিনিময় কার্যক্রম বন্ধ থাকে। এ লক্ষ্যে গত ১ অক্টোবর থেকে ২২ অক্টোবর পর্যন্ত দেশব্যাপী মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান পালিত হয়েছে।
দেশের ২৭ জেলায় ইলিশের প্রজনন ক্ষেত্র প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার। জেলাগুলো হচ্ছে—চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, শরীয়তপুর, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, ঢাকা, মাদারীপুর, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, খুলনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী। ইলিশ প্রজনন ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত এলাকাসমূহ হচ্ছে—ভোলা জেলার মনপুরা ও ঢালচর এবং নোয়াখালী জেলার হাতিয়া, কালিরচর ও মৌলভীরচর।
ইলিশের মোট আয়ুষ্কাল ৫-৭ বছর। আহরিত ইলিশের শতকরা ৯০ ভাগ ৩০-৫০ সেন্টিমিটার আকারের হয়ে থাকে। বাংলাদেশে মোট তিন প্রজাতির ইলিশ পাওয়া যায়; এর মধ্যে দুইটি (চন্দনা ও গোর্তা ইলিশ) সারাজীবন উপকূল ও সাগরে কাটায় এবং অপর একটি মিঠাপানি ও লোনাপানিতে জীবন অতিবাহিত করে। ইলিশ স্রোতের বিপরীতে দৈনিক ৭০ কিলোমিটার পর্যন্ত চলাচল করতে পারে। পৃথিবীর মোট ১১টি দেশে বর্তমানে ইলিশ পাওয়া যায়। দেশগুলো হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, মিয়ানমার, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, কুয়েত, বাহরাইন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ড। বিশ্বে আহরিত ইলিশের প্রায় ৬৫ শতাংশেরও বেশি বাংলাদেশ আহরণ করে; দ্বিতীয় অবস্থানে আছে মিয়ানমার (২০-২৫%) এবং তৃতীয় অবস্থানে ভারত (১৫-২০%)। উল্লেখ্য, ইলিশ উত্পাদনকারী ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়া অপর ১০টি দেশেই ইলিশ উত্পাদন কমেছে। সুষ্ঠু ও সঠিক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল বাস্তবায়নের কারণে একমাত্র বাংলাদেশেই ইলিশ উত্পাদন সাম্প্রতিককালে ৩০ শতাংশ বেড়ে ৫ লক্ষ মে. টন ছাড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ মত্স্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা তথ্য মতে, ১০ বছর আগে দেশের ২১টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যেত। বর্তমানে ১২৫টি উপজেলার নদ-নদীতে ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। পদ্মার শাখানদী মহানন্দা ও তিস্তা নদী এবং মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওর এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার মেদির হাওরেও ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে। এতে প্রমাণিত হয় যে, গবেষণা তথ্যের ভিত্তিতে মত্স্য অধিদপ্তর, প্রশাসন ও বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কর্তৃক ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করায় দেশব্যাপী ইলিশের বিস্তৃতি ও উত্পাদন বেড়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে ইলিশের উত্পাদন ছিল ২.৯৯ লক্ষ মে. টন; ২০১৫-১৬ অর্থবছরে তা হয় ৩.৯৫ লক্ষ মে. টন। ২০১৬-১৭ সালে তা ৫ লক্ষ মে. টন ছাড়িয়ে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অর্থাত্ বিগত ৮ বছরে দেশে ইলিশ উত্পাদন বেড়েছে প্রায় ৩০ শতাংশ—যা বর্তমান সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য। মা ইলিশ ও জাটকা সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণের ফলে দেশে ইলিশ উত্পাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় ভারত এখন বাংলাদেশের ইলিশ ব্যবস্থাপনা কৌশল অনেকাংশে অনুসরণ করছে। ইলিশ উত্পাদনকারী অন্যান্য দেশও বর্তমানে বাংলাদেশকে ইলিশ উত্পাদনের রোল মডেল হিসেবে বিবেচনা করছে।
চলতি বছরে ইলিশ উত্পাদনের এই সাফল্য জেলে সম্প্রদায়ের মাঝে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। জেলেরা অনেকেই এখন বুঝতে পেরেছে যে, মা ইলিশ ও জাটকা সঠিকভাবে সুরক্ষা করতে পারলে বর্ধিত হারে ইলিশ উত্পাদনের সুফল তারা নিজেরাই ভোগ করতে পারবে। এজন্য জেলেরাও অনেক ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ হয়ে মা ইলিশ রক্ষা করছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক।
______________________________________________
👌 লেখক : বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা
ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানী
ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ
মন্তব্যসমূহ