হরেরাম বাড়ি থেকে লাইব্রেরি যাবার পথে বাতাসে একটি বড় গাছ তার সামনে মড় মড় করে ভেঙ্গে পড়ে। ঠিক তেমন বাতাসো নয়। এটা হচ্ছে বৃদ্ধ কালের পতন। অনেক পুরনো গাছ ওটি। জীবনের কতোযে স্মৃতি ওই গাছটার সাথে লুকিয়ে। শৈশবে প্রচন্ড রোদ্দুরে কতোবার ওই গাছটার নিচে আশ্রয় নিয়েছে - জীবনের একটা বিশাল সময় ওই গাছটার নিচ দিয়ে হেঁটেছে।সেই গাছটা কিনা তার চোখের সামনে দুমড়ে মুচড়ে ভেঙ্গে পড়লো। হরেরামের কাছে যদি কোনো বাড়তি শক্তি থাকতো তাহলে সে ওই গাছটাকে কোনদিন ওভাবে পড়তে দিতো না। গাছটার দিকে ক'বার পিছন ফিরে তাকিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।আজ তার লাইব্রেরিতে একটা গুরুত্ব পূর্ণ মিটিং হবে, হরেরাম জানে না কী হবে লাইব্রেরির ভবিষ্যৎ।
সেই শৈশব থেকে সে লাইব্রেরিতে চাকরি করছে, ঝড়, বৃষ্টি কোনো কিছুই হরেরামকে প্রতিরোধ করতে পারে নাই। কেউ না আসলেও সে একাই গেছে। পঞ্চান্ন বছরের অভ্যেস কিভাবে বাদ দেয়।সপ্তাহিক বন্ধের দিনটাও মাঝে মধ্যে গিয়ে বইগুলো নড়াচড়া করে। খুঁটেখুঁটে দেখে কোথাও কোনো পোকা কাটলো কিনা। কোনো পাতা ছিঁড়লে পাতলা কাগজ দিয়ে জোড়া লাগায়।
সেই কবেকার কথা। চার ক্লাস পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। স্কুলের হেড মাস্টারের মাথায় ইটের টুকরো দিয়ে একটা ঢিল ছুঁড়ার পর, চিরদিনের জন্য তার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে যায়।পড়া না পারলে হেড স্যার খুব পিটাতো। একদিন শোধ নিতে, বাঁশ বাগানের আড়ালে লুকিয়ে মনের সুখে রেল লাইনের পাথর দিয়ে ইয়া জোরে একটা ঢিল ছোঁড়ে। সোজা গিয়ে ঠক করে লাগে মাস্টারের মাথায়। মাস্টার ওরে বাবারে বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পরে। ওকে চিনতে পেরে শেষে এক তুঘলকি কান্ড।স্কুল বাদ দিলেও গল্প পড়ার অভ্যেসটা ত্যাগ করতে পারেনি। দুই কিলো দূরে শহরের চেনাপুর লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ার চেষ্টা চালায়। লাইব্রেরিতে শত শত বই। দেখলেই মনটা জুরিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে সব বড়রা সদস্য। ছোটদের তেমন একটা প্রবেশাধিকার নেই। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব লাইব্রেরিয়ান আফজাল হাজী প্রচন্ড বদ মেজাজি লোক। দুই দিন ধমকিয়েছে তাকে। আগে ক্লাসের বই পড়ো - বড় হয়ে এসব বই পড়বে। তবুও বিকেল হলেই হরেরাম লাইব্রেরির আশে পাশে গিয়ে ঘোরা ফেরা করে। সেই কবে বড় হবে আর কখন হাজী বই দেবে। মনে মনে ভাবে হাজীটা মরলে কী না ভালো হতো। হাজী মাঝে মধ্যে খুক করে কাশে মরো মরো করেও মরার কোনো লক্ষণ নেই।হাজী সাহেব ওর বই পড়ার প্রচন্ড আগ্রহ বুঝতে পেরে এক সময় ডেকে নিয়ে একটা বই ধরিয়ে দেয়। সেও তার অনেক নিয়ম রীতির মধ্যে। হাজী সাহেব যেইবই দেবে সেটাই পড়তে হবে। স্লেফের কোনো বইয়ে হাত দেয়া যাবে না, লাইব্রেরিতে কথা বলাতো দূরের বিষয় খুক করে কাশিও নিষেধ। ছোট মানুষবিধায় সপ্তাহে দুই দিনের বেশি লাইব্রেরিতে আসতে পারবে না। আরো কতোযে নিয়ম। সব নিয়মে রাজি হয়ে যায় হরেরাম। এক চিলতে হোক তবুও যে পাথর গলেছে এটাই ওর জন্য বড় পাওয়া।
হরেরামের মতো একজন পুঁচকের পক্ষে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়া এটা কম কথা নয়। শহরের সব নামজাদা লোকেরা আসে এখানে -মুন্সেফ, উকিল, মোক্তার, হাইস্কুলের হেড স্যার আরো কতো বড় বড় মাপের মানুষ। সবাই কিন্তু লাইব্রেরিয়ান হাজী সাহেবকে শ্রদ্ধা করে। ষাট বছর থেকে আছেন এই লাইব্রেরিতে। বইয়ের একটি পাতায় দাগ লাগলেও সেটার জন্য জরিমানা গুনতে হয়। শহরের সব চেয়ে স্বনামধন্য ব্যক্তি বলরাম চৌধুরি লাইব্রেরির সভাপতি, তিনি হাজী সাহেবের ছোট বেলার বন্ধু। আগে প্রায় লাইব্রেরিতে আসতেন এখন আর তেমন বাইরে বেরুতে পারেন না। হাজী সাহেবের একজন সহকারী আছে আব্দুর রহিম। সে কারো সাথে কোনো কথা বলে না। আব্দুর রহিমের বয়সো প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই। তার কাজ কেউ কিছুচাইলে সেটা বের করে দেয়া। রহিমের মাসিক বেতন ত্রিশ টাকা। হাজী সাহেব কোনো টাকা নেন না। ওটা তার পেশা নয় নেশা। বাপ দাদারা যা রেখে গেছে তাই দিয়ে হাজী সাহেবের আরো দুই পুরুষ চলে যাবে।
একবার লাইব্রেরির বার্ষিক সভায় হাজী সাহেবের জন্য মাসিক সম্মানি ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছিলো, তিনি সেটা নিতে অস্বিকৃতি জানান। কমিটিকে সাফ জানিয়ে দেন, তার জন্য কোনো বেতন ভাতা নির্ধারণ করা হলেলাইব্রেরি ছেড়ে চলে যাবে। সেই থেকে আর কেউ ওই প্রসঙ্গ তোলেনি।হাজী সাহের চলে গেছে সেই কতো বছর। আজ হরেরামের মনে কতোযে প্রশ্ন কতো স্মৃতির ঝুড়ি। হাজী সাহেব মরার আগে এক বিশাল পাহাড় রক্ষার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে যায় হরেরামের কাঁধে। আজো সেটা শত ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা ও মানব সৃষ্ট ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে আগলে রেখেছে রাম। এখন তার কেনো জানি মনে হয় - সে বুঝি আর পারছে না - হেরে যাচ্ছে হাজী সাহেবের সুরক্ষিত পাহাড় রক্ষায়। এখন আগেকার সেই সব মানুষেরা আর নেই। সেই সভাপতি, সম্পাদক, আগেকার মুন্সেফ, উকিল, মোক্তার। মানুষ বদলের সাথে মানুষের ভাবাবেগ,আচার আচরণ সব কী রকম যেনো বদলে গেছে। এখন আর বই পড়তে তেমন কেউ আসে না। বিকেল বেলা দু'একজন লোক আসে শুধু পত্রিকা পড়ার জন্য। আগে সদস্যদের মাসিক চাঁদা দিয়ে বই কেনা, লাইব্রেরির আসবাব, সংস্কার, সহকারীর বেতন দিয়ে আরো টাকা বাঁচতো। এখন মাসিক সদস্যরা কেউ লাইব্রেরির দিকে মুখই ফেরায় না। কারো কাছে দু'চার বার গেলেও অল্প ক'টা টাকা সেটাই দিতে চায় না।ক'দিন থেকে হরেরামের মন ও শরীর কোনটাই ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে লাইব্রেরির অচল অবস্থা ও বেশ কিছুদিন থেকে কমিটির উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত রামের মনটাকে আরো ভেঙ্গে দিয়েছে। রাম আর কী করতে পারবে -সেতো কমিটির লোক নয়, একজন কর্মচারি মাত্র। শত বছরের এই লাইব্রেরিটার অনতি দূরে হয়েছে সরকারি গণগ্রন্থাগার। ওরা সব দিক থেকে অাধুনিক। না থাকার মধ্যেও যে ক'জন পাঠক আছে তারা এখন সেখানেই যায়। তাদের অনেকগুলো কম্পিউটর চলে। নূতন জেনারেশনের ছেলেরা এখন অধিকাংশ সময় ন্যাট চালায়। পৃথিবীর বিভিন্ন লাইব্রেরির ক্যাটলগ ঘেটে দেখে, বোতাম টিপলেই পৃথিবী এখন স্কীনে ভেসে উঠে। চাঁদা দিতে হয় না। এসি রুম। সরকারি লাইব্রেরির সাথে কোনভাবে এই পুরনো লাইব্রেরিটার পেরে উঠা সম্ভব নয়।লাইব্রেরির আজকের মিটিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।আজকের মিটিংএর উপর নির্ভর করবে এটা থাকবে কী থাকবে না। সবাই যথাসময়ে এসে উপস্থিত হয়। নিয়ম মাফিক শুরু হয় মিটিং এর কার্যক্রম। লাইব্রেরির সম্পাদক সাহের উপস্থিত সুধিমন্ডলির শুভেচ্ছা জানিয়ে যা বলেন, তার মূল সারমর্ম হচ্ছে- বর্তমান ওটা নামকাওয়াস্তে কোনভাবে টিকে আছে। বর্তমান এখানে আর তেমন কেউ আসে না। সরকার একটি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জন্য উদযোগি হয়েছে। এলাকার স্হানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসক সাহেব উভয়ে লাইব্রেরির এই জমিটা স্টেডিয়াম তৈরির জন্য দেয়া যায় কিনা সেজন্য সভাপতি সাহেব ও সম্পাদককে ডেকেছিলো। তারা কমিটির মিটিংয়ের পর সিদ্ধান্ত জানাবে বলে জানিয়েছেন। মিটিংয়ে সম্পাদকের বিচার বিশ্লেষণ ও সভাপতির তাত্বিক আলোচনায় উপস্থিত সুধি বৃন্দের সবাই স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠার পক্ষে সম্মতি দেয়। অনেকে বলেন, এটার যেহেতু এখন সেরকম কোন কার্যক্রম নেই এটা রেখে আর লাভ কি? তাছাড়া স্টেডিয়াম হলে এলাকার হাজার হাজার লোক খেলা উপভোগ করবে। তাদের ছেলে মেয়েরা বড় বড় ক্রিকেটার হয়ে উঠবে, দেশবিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাবে। হরেরাম এতোক্ষণ সবার কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন। সভাপতি যখন সবাইকে হাত তুলে স্টেডিয়ামেরপক্ষে সম্মতি চান। হরেরাম না, না বলে চিৎকার দিয়ে উঠেন। এর আগে কেউ কোনোদিন হরেরামের এরকম প্রতিবাদী কন্ঠস্বর শোনেনি। তিনি বলেন, আপনারা শত বছরের এই ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরিকে হত্যা করতে পারেন না। এটা অন্যায়।সবাই তার এরকম আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কেউ কিছু বলার আগে সভাপতি সাহেব উঠে দাঁড়ান।
বলেন, আপনারা দাদার কথায় মনে কিছু নেবেন না। তিনি তার প্রায় শৈশবকাল থেকে এই লাইব্রেরির সাথে জড়িত, এটাকে সন্তানের মতো আগলে আছেন। কাজেই তার পক্ষে আবেগ তাড়িত হওয়া স্বাভাবিক এবং আমার ধারনা এই লাইব্রেরিকে ভালোবেসেই জীবনে আর বিয়ে থা করেননি। তিনি এখন বার্দ্ধকে পৌঁছেছেন, এই শেষ বয়সে আর কোথায় যাবেন। তিনি এখানে যে বেতন পান তার বাকি জীবন কাটানোর জন্য এর চেয়ে অধিক বেতনে- সভাপতির আবাসিক হোটেলে চাকরির ব্যাবস্থা করে দেবেন। এসময় আরো অনেকে উঠে - রাম দাদাকে কেউ তার ফার্মে, কেউ ইট ভাটায়, কেউ জুতার দোকানে চাকরির কথা বলেন। মূহুর্তে অনেকগুলো চাকরি জুটে যায় হরেরাম দাদার। তিনি নিশ্চুপ পাথরের মতো বসে থাকেন -তার মুখের সব ভাষা হারিয়ে যায়।মিটিং শেষে একে একে সবাই চলে যায় থাকে শুধুহরেরাম। প্রতিদিনের মতোই লাইব্রেরির জানালা কপাট লাগিয়ে নিজের হাজিরা খাতায় সই করে দরজার দিকে এগিয়ে যান তিনি। এসময় হরেরামের দু'চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। তালা লাগানোর পর তিনি হাউহাউ করে কেঁদে উঠেন। সে কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায় না, শোনে শুধু একাই হরেরাম।পরের দিন সকালে লাইব্রেরির সভাপতির বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় একজন ত্রিশোর্ধ যুবক। সভাপতি সাহেব বেরুতে লাইব্রির চাবিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলে, জ্যেঠু গতকাল মরার কিছুক্ষণ আগে চাবিটা আপনাকে দিতে বলেছেন। সভাপতি কিছুক্ষণ স্থির থেকে বলেন, কিভাবে মারা গেলো?ছেলিটি বলে, বুকে ব্যথা হয়েছিলো। তারপর ক'টা হেঁচকি দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। সভাপতি জানতে চায় তার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া কখন হবে? ছেলেটি সময়ের কথা বলে চলে যায়। তিনি ছেলেটির যাত্রা পথে নিস্তব্ধ তাকিয়ে থাকেন।
____________________
♦আমাদের শিল্পসাহিত্য
সেই শৈশব থেকে সে লাইব্রেরিতে চাকরি করছে, ঝড়, বৃষ্টি কোনো কিছুই হরেরামকে প্রতিরোধ করতে পারে নাই। কেউ না আসলেও সে একাই গেছে। পঞ্চান্ন বছরের অভ্যেস কিভাবে বাদ দেয়।সপ্তাহিক বন্ধের দিনটাও মাঝে মধ্যে গিয়ে বইগুলো নড়াচড়া করে। খুঁটেখুঁটে দেখে কোথাও কোনো পোকা কাটলো কিনা। কোনো পাতা ছিঁড়লে পাতলা কাগজ দিয়ে জোড়া লাগায়।
সেই কবেকার কথা। চার ক্লাস পর্যন্ত পড়ার পর আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। স্কুলের হেড মাস্টারের মাথায় ইটের টুকরো দিয়ে একটা ঢিল ছুঁড়ার পর, চিরদিনের জন্য তার লেখা পড়া বন্ধ হয়ে যায়।পড়া না পারলে হেড স্যার খুব পিটাতো। একদিন শোধ নিতে, বাঁশ বাগানের আড়ালে লুকিয়ে মনের সুখে রেল লাইনের পাথর দিয়ে ইয়া জোরে একটা ঢিল ছোঁড়ে। সোজা গিয়ে ঠক করে লাগে মাস্টারের মাথায়। মাস্টার ওরে বাবারে বলে চিৎকার দিয়ে মাটিতে বসে পরে। ওকে চিনতে পেরে শেষে এক তুঘলকি কান্ড।স্কুল বাদ দিলেও গল্প পড়ার অভ্যেসটা ত্যাগ করতে পারেনি। দুই কিলো দূরে শহরের চেনাপুর লাইব্রেরিতে গিয়ে বই পড়ার চেষ্টা চালায়। লাইব্রেরিতে শত শত বই। দেখলেই মনটা জুরিয়ে যায়। কিন্তু সেখানে সব বড়রা সদস্য। ছোটদের তেমন একটা প্রবেশাধিকার নেই। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব লাইব্রেরিয়ান আফজাল হাজী প্রচন্ড বদ মেজাজি লোক। দুই দিন ধমকিয়েছে তাকে। আগে ক্লাসের বই পড়ো - বড় হয়ে এসব বই পড়বে। তবুও বিকেল হলেই হরেরাম লাইব্রেরির আশে পাশে গিয়ে ঘোরা ফেরা করে। সেই কবে বড় হবে আর কখন হাজী বই দেবে। মনে মনে ভাবে হাজীটা মরলে কী না ভালো হতো। হাজী মাঝে মধ্যে খুক করে কাশে মরো মরো করেও মরার কোনো লক্ষণ নেই।হাজী সাহেব ওর বই পড়ার প্রচন্ড আগ্রহ বুঝতে পেরে এক সময় ডেকে নিয়ে একটা বই ধরিয়ে দেয়। সেও তার অনেক নিয়ম রীতির মধ্যে। হাজী সাহেব যেইবই দেবে সেটাই পড়তে হবে। স্লেফের কোনো বইয়ে হাত দেয়া যাবে না, লাইব্রেরিতে কথা বলাতো দূরের বিষয় খুক করে কাশিও নিষেধ। ছোট মানুষবিধায় সপ্তাহে দুই দিনের বেশি লাইব্রেরিতে আসতে পারবে না। আরো কতোযে নিয়ম। সব নিয়মে রাজি হয়ে যায় হরেরাম। এক চিলতে হোক তবুও যে পাথর গলেছে এটাই ওর জন্য বড় পাওয়া।
হরেরামের মতো একজন পুঁচকের পক্ষে লাইব্রেরিতে বসে বই পড়া এটা কম কথা নয়। শহরের সব নামজাদা লোকেরা আসে এখানে -মুন্সেফ, উকিল, মোক্তার, হাইস্কুলের হেড স্যার আরো কতো বড় বড় মাপের মানুষ। সবাই কিন্তু লাইব্রেরিয়ান হাজী সাহেবকে শ্রদ্ধা করে। ষাট বছর থেকে আছেন এই লাইব্রেরিতে। বইয়ের একটি পাতায় দাগ লাগলেও সেটার জন্য জরিমানা গুনতে হয়। শহরের সব চেয়ে স্বনামধন্য ব্যক্তি বলরাম চৌধুরি লাইব্রেরির সভাপতি, তিনি হাজী সাহেবের ছোট বেলার বন্ধু। আগে প্রায় লাইব্রেরিতে আসতেন এখন আর তেমন বাইরে বেরুতে পারেন না। হাজী সাহেবের একজন সহকারী আছে আব্দুর রহিম। সে কারো সাথে কোনো কথা বলে না। আব্দুর রহিমের বয়সো প্রায় ষাট ছুঁই ছুঁই। তার কাজ কেউ কিছুচাইলে সেটা বের করে দেয়া। রহিমের মাসিক বেতন ত্রিশ টাকা। হাজী সাহেব কোনো টাকা নেন না। ওটা তার পেশা নয় নেশা। বাপ দাদারা যা রেখে গেছে তাই দিয়ে হাজী সাহেবের আরো দুই পুরুষ চলে যাবে।
একবার লাইব্রেরির বার্ষিক সভায় হাজী সাহেবের জন্য মাসিক সম্মানি ভাতা নির্ধারণ করা হয়েছিলো, তিনি সেটা নিতে অস্বিকৃতি জানান। কমিটিকে সাফ জানিয়ে দেন, তার জন্য কোনো বেতন ভাতা নির্ধারণ করা হলেলাইব্রেরি ছেড়ে চলে যাবে। সেই থেকে আর কেউ ওই প্রসঙ্গ তোলেনি।হাজী সাহের চলে গেছে সেই কতো বছর। আজ হরেরামের মনে কতোযে প্রশ্ন কতো স্মৃতির ঝুড়ি। হাজী সাহেব মরার আগে এক বিশাল পাহাড় রক্ষার দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে যায় হরেরামের কাঁধে। আজো সেটা শত ঝড়, বৃষ্টি, বন্যা ও মানব সৃষ্ট ভূমিকম্পের মধ্য দিয়ে আগলে রেখেছে রাম। এখন তার কেনো জানি মনে হয় - সে বুঝি আর পারছে না - হেরে যাচ্ছে হাজী সাহেবের সুরক্ষিত পাহাড় রক্ষায়। এখন আগেকার সেই সব মানুষেরা আর নেই। সেই সভাপতি, সম্পাদক, আগেকার মুন্সেফ, উকিল, মোক্তার। মানুষ বদলের সাথে মানুষের ভাবাবেগ,আচার আচরণ সব কী রকম যেনো বদলে গেছে। এখন আর বই পড়তে তেমন কেউ আসে না। বিকেল বেলা দু'একজন লোক আসে শুধু পত্রিকা পড়ার জন্য। আগে সদস্যদের মাসিক চাঁদা দিয়ে বই কেনা, লাইব্রেরির আসবাব, সংস্কার, সহকারীর বেতন দিয়ে আরো টাকা বাঁচতো। এখন মাসিক সদস্যরা কেউ লাইব্রেরির দিকে মুখই ফেরায় না। কারো কাছে দু'চার বার গেলেও অল্প ক'টা টাকা সেটাই দিতে চায় না।ক'দিন থেকে হরেরামের মন ও শরীর কোনটাই ভালো যাচ্ছে না। বিশেষ করে লাইব্রেরির অচল অবস্থা ও বেশ কিছুদিন থেকে কমিটির উল্টোপাল্টা সিদ্ধান্ত রামের মনটাকে আরো ভেঙ্গে দিয়েছে। রাম আর কী করতে পারবে -সেতো কমিটির লোক নয়, একজন কর্মচারি মাত্র। শত বছরের এই লাইব্রেরিটার অনতি দূরে হয়েছে সরকারি গণগ্রন্থাগার। ওরা সব দিক থেকে অাধুনিক। না থাকার মধ্যেও যে ক'জন পাঠক আছে তারা এখন সেখানেই যায়। তাদের অনেকগুলো কম্পিউটর চলে। নূতন জেনারেশনের ছেলেরা এখন অধিকাংশ সময় ন্যাট চালায়। পৃথিবীর বিভিন্ন লাইব্রেরির ক্যাটলগ ঘেটে দেখে, বোতাম টিপলেই পৃথিবী এখন স্কীনে ভেসে উঠে। চাঁদা দিতে হয় না। এসি রুম। সরকারি লাইব্রেরির সাথে কোনভাবে এই পুরনো লাইব্রেরিটার পেরে উঠা সম্ভব নয়।লাইব্রেরির আজকের মিটিংটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।আজকের মিটিংএর উপর নির্ভর করবে এটা থাকবে কী থাকবে না। সবাই যথাসময়ে এসে উপস্থিত হয়। নিয়ম মাফিক শুরু হয় মিটিং এর কার্যক্রম। লাইব্রেরির সম্পাদক সাহের উপস্থিত সুধিমন্ডলির শুভেচ্ছা জানিয়ে যা বলেন, তার মূল সারমর্ম হচ্ছে- বর্তমান ওটা নামকাওয়াস্তে কোনভাবে টিকে আছে। বর্তমান এখানে আর তেমন কেউ আসে না। সরকার একটি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের জন্য উদযোগি হয়েছে। এলাকার স্হানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা প্রশাসক সাহেব উভয়ে লাইব্রেরির এই জমিটা স্টেডিয়াম তৈরির জন্য দেয়া যায় কিনা সেজন্য সভাপতি সাহেব ও সম্পাদককে ডেকেছিলো। তারা কমিটির মিটিংয়ের পর সিদ্ধান্ত জানাবে বলে জানিয়েছেন। মিটিংয়ে সম্পাদকের বিচার বিশ্লেষণ ও সভাপতির তাত্বিক আলোচনায় উপস্থিত সুধি বৃন্দের সবাই স্টেডিয়াম প্রতিষ্ঠার পক্ষে সম্মতি দেয়। অনেকে বলেন, এটার যেহেতু এখন সেরকম কোন কার্যক্রম নেই এটা রেখে আর লাভ কি? তাছাড়া স্টেডিয়াম হলে এলাকার হাজার হাজার লোক খেলা উপভোগ করবে। তাদের ছেলে মেয়েরা বড় বড় ক্রিকেটার হয়ে উঠবে, দেশবিদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ টাকা কামাবে। হরেরাম এতোক্ষণ সবার কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিলেন। সভাপতি যখন সবাইকে হাত তুলে স্টেডিয়ামেরপক্ষে সম্মতি চান। হরেরাম না, না বলে চিৎকার দিয়ে উঠেন। এর আগে কেউ কোনোদিন হরেরামের এরকম প্রতিবাদী কন্ঠস্বর শোনেনি। তিনি বলেন, আপনারা শত বছরের এই ঐতিহ্যবাহী লাইব্রেরিকে হত্যা করতে পারেন না। এটা অন্যায়।সবাই তার এরকম আচরণে স্তম্ভিত হয়ে যায়। কেউ কিছু বলার আগে সভাপতি সাহেব উঠে দাঁড়ান।
বলেন, আপনারা দাদার কথায় মনে কিছু নেবেন না। তিনি তার প্রায় শৈশবকাল থেকে এই লাইব্রেরির সাথে জড়িত, এটাকে সন্তানের মতো আগলে আছেন। কাজেই তার পক্ষে আবেগ তাড়িত হওয়া স্বাভাবিক এবং আমার ধারনা এই লাইব্রেরিকে ভালোবেসেই জীবনে আর বিয়ে থা করেননি। তিনি এখন বার্দ্ধকে পৌঁছেছেন, এই শেষ বয়সে আর কোথায় যাবেন। তিনি এখানে যে বেতন পান তার বাকি জীবন কাটানোর জন্য এর চেয়ে অধিক বেতনে- সভাপতির আবাসিক হোটেলে চাকরির ব্যাবস্থা করে দেবেন। এসময় আরো অনেকে উঠে - রাম দাদাকে কেউ তার ফার্মে, কেউ ইট ভাটায়, কেউ জুতার দোকানে চাকরির কথা বলেন। মূহুর্তে অনেকগুলো চাকরি জুটে যায় হরেরাম দাদার। তিনি নিশ্চুপ পাথরের মতো বসে থাকেন -তার মুখের সব ভাষা হারিয়ে যায়।মিটিং শেষে একে একে সবাই চলে যায় থাকে শুধুহরেরাম। প্রতিদিনের মতোই লাইব্রেরির জানালা কপাট লাগিয়ে নিজের হাজিরা খাতায় সই করে দরজার দিকে এগিয়ে যান তিনি। এসময় হরেরামের দু'চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। তালা লাগানোর পর তিনি হাউহাউ করে কেঁদে উঠেন। সে কান্নার শব্দ কেউ শুনতে পায় না, শোনে শুধু একাই হরেরাম।পরের দিন সকালে লাইব্রেরির সভাপতির বাড়িতে গিয়ে হাজির হয় একজন ত্রিশোর্ধ যুবক। সভাপতি সাহেব বেরুতে লাইব্রির চাবিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলে, জ্যেঠু গতকাল মরার কিছুক্ষণ আগে চাবিটা আপনাকে দিতে বলেছেন। সভাপতি কিছুক্ষণ স্থির থেকে বলেন, কিভাবে মারা গেলো?ছেলিটি বলে, বুকে ব্যথা হয়েছিলো। তারপর ক'টা হেঁচকি দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। সভাপতি জানতে চায় তার অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া কখন হবে? ছেলেটি সময়ের কথা বলে চলে যায়। তিনি ছেলেটির যাত্রা পথে নিস্তব্ধ তাকিয়ে থাকেন।
____________________
♦আমাদের শিল্পসাহিত্য
মন্তব্যসমূহ